বিশিষ্ট ব্যক্তি

শুভ জন্মদিন ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজা (কৌশিক), আমাদের নড়াইল এক্সপ্রেস।

চিত্রা পাড়ে ১৯৮৩ সালের ৫ই অক্টোবর পূর্ণিমা রাতে জন্ম হয় মাশরাফির! আমাদের নড়াইল এক্সপ্রেসের। বড় হয়েছেন নানার বাড়িতে। সেই নানার এক হস্তরেখাবিদ বন্ধু বলেছিলেন ফাড়া আছে এই ছেলের জীবনে। কে জানে হয়তো সেই ফাঁড়াই এখনো কাটেনি। দশ বছর বয়সে একবার পড়ে গিয়েছিলেন নানা বাড়ির তিনতলা থেকে। আশ্চর্য ব্যাপার তেমন কোনো আঘাত হয়নি তখন। সেই থেকে আমাদের মাশরাফি শিখে গেছেন উঠে দাঁড়ানো।

অভিষেক ২০০১ সালে। ইনজুরির অভিষেকও ২০০১ এ! ক্যারিয়ারের বয়স সতেরো বছর, লড়াইও সমবয়সী ক্যারিয়ারের। সতেরো বছরে তিন এঙ্কেলের লিগামেন্ট ছিড়েছে সাতবার। দুই হাঁটুতে ছুরি কাঁচি চলে সাত বার, তাঁর মধ্যে ডান হাঁটুতে তিনবার আর বামটাতে চারবার। ২০০১ এ পেয়েছিলেন পেট আর বুকে চোট, ২০০৬ এ পেয়েছেন পিঠের হাড়ে। তারপরও শিক্ষা হয়নাই, এখনও বল ধরতে ঝাপিয়ে পড়েন আগের মতো।

এই ঝাপিয়ে পড়তে গিয়েই কয়দিন আগে হাতের কনিষ্ঠা আঙুল ভেঙ্গেছেন! প্রতিবার শুন্য থেকে শুরু করার শিক্ষা তাঁর হয়ে গেছে কবেই! এতো ইনজুরিকে তাই খুব একটা গায়ে মাখেন না তিনি। উল্টো মুখ বাঁকিয়ে বলেন “ফ্র্যাকচার যেহেতু নেই, পেইনকিলার ইনজেকশন নিয়ে খেলে ফেলতে পারব আশা করি। আগের ম্যাচটা তো সেভাবেই খেললাম”। শুনে হয়তো মনে হচ্ছে এ আর এমন কি? অভ্যাস হয়েছে সইতে সইতে! সেই অভ্যাসের কথাতেই আসি..

মন যতটা শক্ত পাগলার শরীর অতোটা পারেনা কখনো। এত এত অস্ত্রোপচারের কারণে কিছুদিন পর পরই তরল জমে যায় হাঁটুতে, তখন বের করে আনতে হয় সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে। এই টেনে নেয়ার মুহূর্তে খুব অসহায় থাকেন তিনি, তীব্র ব্যাথায় তাঁর চিৎকার শুধু কাছের মানুষরাই দেখেন। প্রতিটি ম্যাচের পর নিতে হয় থ্যারাপি। তারপরও কেনো খেলে যাচ্ছেন? কিসের টানে?

“প্রথমত আমি খেলতে ভালোবাসি। বাংলাদেশের পক্ষে খেলাটা বিশাল এক ব্যাপার। আমি চিন্তাও করতে পারি না যে বাংলাদেশের হয়ে খেলছি না।” অনেকে বলেন ক্রিকেটে অর্থের ঝনঝনানি । কে ছাড়তে চাইবে এমন নিশ্চিত আয়ের উৎস ? রাখেন ! জবাব আছে আপনাদের জন্যেও ।

আমার স্পষ্ট মনে নেই কোন সিজন, প্রিমিয়ার লীগে বিমানের হয়ে খেলার কথা ছিলো ম্যাশের । ইনজুরীর কারণে খেলা হয়নি তাই পরের সিজন পুরোটাই খেলে দিয়েছিলেন বিনা ম্যাচ ফি তে !

গ্লাডিয়েটরসে বেস প্রাইসেই বিকিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, “আমার দুঃসময়ে আমাকে দলে নিয়েছেন তাই আমি কৃতজ্ঞ ।” তারপর ঢেলে দিয়েছেন পুরোটা, ফলাফল টানা দুই সিজনের চ্যাম্পিয়ন দলের অনেকের নামই যখন আমরা শুনি ফিক্সারদের কাতারে তখন ম্যাশ প্রস্তাব পেয়েও জানিয়ে দেন বোর্ড কে ! এরপরে ১৫ এর নড়ভড়ে কুমিল্লা দলকে করেছেন চ্যাম্পিয়ন! গত আসরেও রংপুর চ্যাম্পিয়ন আর দলপতি সেই ম্যাশই!

ব্যাক্তিগত জীবনেও পরোপকারী আমাদের “কৌশিক”, নড়াইলে কয়াজ করে চলেছেন অনাথ শিশু কিশোরদের জন্য, “চেষ্টা করলে কম- বেশি সম্পদ যে কেউ করতে পারে। জীবনে একেবারে কম উপার্জন করিনি। আমি সে অর্থ একার জন্য রাখতে চাইনি। নড়াইলে টিনশেড ঘরের জায়গায় হয়তো বিল্ডিং থাকত। কিন্তু এখন যে ভালোবাসা পাই সেটা কী পেতাম। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই। আমার দ্বারা যদি কারও সামান্য উপকার হয় এতেই খুশি ।”

আক্ষেপ থাকে মহানায়কদের জীবনেও । ১৯ জানুয়ারি ২০১১ ! হ্যা এই দিনটাই কালো দিন… দেশের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার জন্যে কি করেননি তিনি ? বোর্ড কথা দিয়েছিলো ফিট হলে দলে নাম উঠবে তাঁর, দেশের মাটিতে খেলার জন্যেই হয়তো নির্ধারিত সময়ের আগেই খেলে দেখিয়েছিলেন ঘরোয়া ম্যাচ । কিন্তু একাডেমি সিডন্স যখন বললেন, “তুমি নেই পরিকল্পনায়” । রাগে ক্ষোভে প্রতারিত হবার কষ্টে কথা বলতে পারেন নি সেদিন শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন । তারপরও কখনো শতভাগ দিয়ে খেলেননি এমন ম্যাচ দেখাতে পারবেনা কেউ ।

ভারতের কাছে শেষ বলে ম্যাচ হারানোর পরও আমরা প্রথম বলে ভরসা করি মাশরাফিতেই । ড্রেসিং রুমে বা ম্যাচের কঠিনতম ইন্সপিরেশনাল স্পিচের জন্য “পাগলা”র দিকে তাকিয়ে থাকেন সবাই । ব্যাডপ্যাচের ভেতরদিয়ে যাওয়া সতীর্থরা প্রেরণা ম্যাশের মধ্যেই । মাশরাফিও জানেন এই নির্ভরতার কথা।

ব্যাক্তিগত জীবনেও প্রচণ্ড আবেগী আমাদের ম্যাশ। ২০০৩ বিশ্বকাপের সময় যখন প্রথম বল হাতে নিলেন তখনো নাকি জলে টলোমলো করছিলো চোখ! দেশকে শ্রদ্ধা করেন খুব। প্রথম আলো তে একবার লিখে ছিলেন “খেলোয়াড় হিসেবে একটাই আশা, আমার পতাকাকে সবাই আরও বেশি সম্মান করবে। ক্রিকেট মাঠে পতাকা শুধু ওড়ার জন্য উড়বে না, জাতীয় সংগীত শুধু বাজার জন্য বাজবে না; লাল-সবুজ পতাকা দেখে যেন এর আগুনটা টের পায় প্রতিপক্ষ। বাতাসে পতাকার আন্দোলন যেন ভয়ের কাঁপন ধরায় তাদের মনে”।

অনেকেরই জানা নেই মাশরাফির প্রপিতামহ হাতেম মোল্লা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, কাজ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের । তখন বয়স কতো ছিলো তাঁর জানেন? ৭০! বয়স হার মানিয়ে লড়াই করার এই চেতনা সম্ভবত রক্তে আছে তাঁর প্রপৌত্রের! নিজেও অনুপ্রেরণা খুঁজেন মুক্তিযোদ্ধাদেরই কাছে, “বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার প্রেরণাও পাই সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকেই ।”

এমনও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। ২/৩টা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা হচ্ছে। তখন তাঁদের স্মরণ করেছি। নিজেকে বলেছি, ‘হাত-পায়ে গুলি লাগার পরও তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন কীভাবে? তোর তো একটা মাত্র লিগামেন্ট নেই! দৌড়া…” সব বাধাকে পেছনে ঠেলে নতুন বল নিয়ে প্রথম বল থেকেই ঠিকই দৌড়ে যাচ্ছেন মাশরাফি।

অকুতোভয়ের মতো যখন ঝাপিয়ে পড়ছেন ফিল্ডিংয়ে তখন আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি “এই বুঝি গেলো আবার”। শুধু আমরাই কুকড়ে যাচ্ছি তা কিন্তু না! ১৭ বছর ধরে কুকড়ে আছেন আরো একজন, তিনি হামিদা মর্তুজা । মাশরাফির মা! খেলা দেখেন না কারণ সন্তানের যন্ত্রনা তাঁর সহ্য হয়না । মাঠে যখন মাশরাফি দেশের পতাকা নিয়ে খেলেন, মা হামিদা তখন জায়-নামাজে খোদার কাছে পড়ে থাকেন যেন সন্তানের বিপদ না হয়।

“দেশের পতাকা হাতে দেশের জন্য দৌড়ানোর গর্ব আর কিছুতেই নেই। পায়ে আরও হাজারটা অস্ত্রোপচার হোক, এই দৌড় থামাতে চাই না আমি … ” আমরাও চাই দৌড়ে যান মাশরাফি। উইকেট পাওয়ার আনন্দে ২ হাতে ডানা মেলে দৌড়ে যান। আর আমরাও লিখে যাব তার কামব্যাক করার গল্প। একসময় মাশরাফির ফিরে এসে সাম্রাজ্য জয়ের কথা পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

Courtesy: Sarjil Ahmed Sagor

error: Hi, কপি করার কি দরকার? আমাকে মেইলে জানান।